আমাদের হিন্দু ধর্ম সাম্যবাদী ধর্ম। তাহলে কেন এই বর্ণ প্রথা?



প্রথমেই বলে নিই, হিন্দু সমাজে চারটি বর্ণ প্রচলিত আছে। যথাঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র। আমরা মনে করি যে, একজন ব্রাহ্মণের পুত্রই ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়ের পুত্রই ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের পুত্রই বৈশ্য, শূদ্রের পুত্রই শূদ্র। আসলে ঘটনাটি সঠিক নয়।

এই সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ব্রাহ্মণ কি, ক্ষত্রিয় কি, বৈশ্য কি এবং শূদ্র কি ?


ব্রাহ্মণ :- ব্রহ্মজ্ঞানে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ব্যক্তি, যিনি সত্ত্বঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।

ক্ষত্রিয় :- শাসক বা যোদ্ধা সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি, যিনি রজঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।

বৈশ্য :- ব্যবসায় সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি, যিনি রজঃ ও তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত ।

শূদ্র :- শ্রমজীবী সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন শূদ্র, যিনি তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত ।


অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা তপস্যা করেন, ক্ষত্রিয়রা শাসন ও যুদ্ধ করেন, বৈশ্যরা ব্যবসায় করেন এবং শূদ্ররা শ্রমবিক্রি করে জীবনযাপন করে । আমরা এর মাধ্যমে বুঝতে পারছি যে, যে যেরকম কর্ম করবে, সে সেই উল্লিখিত বর্ণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ একজন শূদ্রের পূত্র যদি ব্রহ্মজ্ঞানে দীক্ষিত হয় তাহলে সে ব্রাহ্মণ হবে এবং ঠিক এভাবেই একজন ব্রাহ্মণের পুত্র যদি শ্রমবিক্রি করে জীবনযাপন করে তাহলে সে শূদ্র হবে। এইযে বর্ণবিভাজন-এটা কিন্তু জন্মভেদে নয় কর্মভেদে।



বর্ণপ্রথা সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলেছেন :-

চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ তস্য কর্তারমপিমাং বিদ্ব্যকর্তারসব্যয়ম (৪/১৩) অর্থাৎ,

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন আমি চার বর্ণের রচনা করেছি। কিন্তু আমি মানুষকে চারটি শ্রেণিতে বিভাগ করিনি। গুণের আধারে কর্মকে চারভাগে বিভক্ত করেছি। গুণ এখানে মানদন্ড। কর্ম একটাই-নিয়ত কর্ম, আরাধনা। অবস্থাভেদে এই কর্মকেই উঁচুনিচু শ্রেণিতে বিভাগ করা হয়েছে। সুতরাং ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই যে ব্রাহ্মণ হবে এমনটি নয়। কোন শূদ্রের সন্তানও ব্রাহ্মণ হতে পারে। আবার শূদ্রের সন্তান যে শূদ্র হবে এমনটি নয়। কোন ব্রাহ্মণের সন্তান যদি শ্রমবিক্রি করে জীবনযাপন করে তাহলে সে শূদ্র বলে গণ্য হবে। এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে নিজ নিজ কর্মের উপর। কিন্তু কালক্রমে এই বর্ণপ্রথা জন্মগত হয়ে দাঁড়ায়, যেমন – ব্রাহ্মণের সন্তান হয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের সন্তান হয় ক্ষত্রিয়, অনুরূপভাবে বৈশ্য, শূদ্র জন্মগত অধিকারে পরিচিত হয়। এর ফলে দেখা গেল একই পরিবারের চার সন্তান চার রকম গুণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু জন্মগত কর্মবিভাজনে তাদের চারজনকে একই কর্ম করতে হচ্ছে। ফলে কর্মের দক্ষতা এরা দেখাতে পারছে না। বর্ণভেদ পেশাগত ; অবশ্যই জন্মগত নয়। ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, একজন ঋষি বলছেন, আমি বেদমন্ত্র দ্রষ্টা ঋষি, আমার কন্যা যব ভেজে ছাতু বানিয়ে বিক্রি করে এবং আমার ছেলে চিকিৎসক। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বর্ণভেদ বংশানুক্রমিক ছিল না। যদি বংশানুক্রমিক থাকত তাহলে তার কন্যা ও পুত্র আলাদা কর্ম করত না। আরও একটি উদাহরণ হচ্ছে বিশ্বামিত্র। যিনি একজন ক্ষত্রিয়ের রাজপুত্র ছিলেন এবং তিনি তপস্যার বলে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া বৈশ্য থেকে ব্রাহ্মণ হওয়ার উদাহরণও আমাদের সনাতন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ গুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু একালেও বংশের ভিত্তিতে বর্ণ নির্ধারিত হচ্ছে। এ-বংশানুক্রমিক বর্ণভেদ প্রথা হিন্দুধর্মাবলম্বী একত্বের জন্য প্রতিবন্ধক এবং ভ্রাতত্বের বন্ধনের প্রতিকূল। সমাজ পরিবর্তনশীলতায় এ-প্রথার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রেই সমাজের সচেতনত পরিবারগুলো এ- প্রথার গোঁড়ামির প্রতিকূলে অবস্থান নিয়ে পারিবারিক কাজ সম্পাদন করছেন। পেশাগত বর্ণভেদের মূল লক্ষ্য ছিল পেশার উৎকর্ষসাধন ও নৈতিক গুণাবলির বিকাশের মাধ্যমে সামাজিক মঙ্গলসাধন করা। কিন্তু এই বর্ণপ্রথা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে সবাই এর বিরোধী। তাই এ-দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়।
Previous
Next Post »